কুরবানির তাৎপর্য কি :
আরবি শব্দ আদহা বা আযহার বাংলা প্রতিশব্দ হলো কুরবানি। কুরবানি অর্থ নৈকট্য, উৎসর্গ, বিসর্জন ও ত্যাগ ইত্যাদি। কুরবানি হলো ঈদুল আযহার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। কুরবানি আমাদের সামনে নিয়ে আসে ত্যাগের এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কুরবানি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত এবং ইসলামের একটি প্রাচীন ঐতিহ্যও বটে। কুরবানি সম্পর্কে মহান আলাহ তায়ালা ঘোষণা করেন, আমি নির্ধারণ করেছি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কুরবানির নিয়ম যাতে তারা আলাহর নাম স্মরণ করে গৃহপালিত চতুস্পদ জন্তুও উপরে (সূরা হজ্জ: ৩৪)। শরীয়তের পরিভাষায়, আলাহ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে জিলহজ্জ মাসের ১০, ১১ ও ১২ এই তিন দিন আলাহর নামে হালাল পশু নির্দিষ্ট নিয়মে জবেহ করার নামই কুরবানি। ত্যাগ-তিতিক্ষা ও নিজের সর্বাধিক প্রিয়বস্তু আলাহর রেজামন্দির জন্য উৎসর্গ করাই কুরবানির তাৎপর্য।
কুরবানি কার উপর ওয়াজিব :
প্রত্যেক সুস্থ জ্ঞানের অধিকারী, পূর্ণ বয়স্ক এবং মুকীম (মুসাফির নয়) ব্যক্তির উপর কুরবানি ওয়াজিব যাদের কাছে ১০ জিলহজ্জ ফজর থেকে ১২ জিলহজ্জ সন্ধা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে নিসাব পরিমাণ মাল আছে। তবে কুরবানি ওয়াজিব হওয়ার জন্য যাকাতের নিসাবের মত সম্পদের মালিকানা এক বছর অতিবাহিত হওয়া শর্ত নয়। বরং কুরবানির তিন দিনের মধ্যে যে কোনো দিন থাকলেই কুরবানি ওয়াজিব হবে। যাকাতের নেছাবের ক্ষেত্রে ঘরের আসবাবপত্র বা ঘরের মূল্য ইত্যাদি হিসেবে ধরা হয় না, কিন্তু কুরবানির ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যকীয় আসবাবপত্র ব্যতীত অন্যান্য আসবাবপত্র, সৌখিন দ্রব্যাদি, খালি ঘর বা ভাড়ার ঘর (যার ভাড়ার উপর তার জীবিকা নির্ভরশীল নয়) এমন কিছুর মূল্যও হিসেবে ধরা হয়।
কুরবানির পশুতে আকীকা করা :
কুরবানির গরু, মহিষ ও উটে আকীকার নিয়ত করা যাবে। এতে কুরবানি ও আকীকা দুটোই সহীহ হবে।
নাবালেগ বাচ্চার কুরবানি :
নাবালেগ শিশু-কিশোর এবং তদ্রুপ যে সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন নয়, নেসাবের মালিক হলেও তাদের উপর কুরবানি ওয়াজিব নয়। অবশ্য তার অভিভাবক নিজ সম্পদ দ্বারা তাদের পক্ষে কুরবানি করলে তা সহীহ হবে।
কয়টি কুরবানি ওয়াজিব :
একজনের জন্য একটি কুরবানিই ওয়াজিব। তবে ইচ্ছা করলে যতো খুশি কুরবানি করা যায়। হযরত জাবির রা. থেকে বর্ণিত একটি দীর্ঘ হাদীসে আছে, ‘অতঃপর নবী কারীম (সা.) কুরবানির স্থানে এলেন এবং নিজ হাতে তেষট্টিটি উট কুরবানি করলেন (সহীহ মুসলিম)।
কোন কোন পশু দ্বারা কুরবানি করা যাবে :
উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা দ্বারা কুরবানি করা জায়েয। এসব গৃহপালিত পশু ছাড়া অন্যান্য পশু যেমন হরিণ, বন্যগরু ইত্যাদি দ্বারা কুরবানি করা জায়েয নয়। যেসব পশু কুরবানি করা জায়েজ সেগুলোর নর-মাদা দুটোই কুরবানি করা যায়।
কুরবানির পশুর বয়সসীমা :
উট কমপক্ষে ৫ বছরের হতে হবে। গরু ও মহিষ কমপক্ষে ২ বছরের হতে হবে। আর ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা কমপক্ষে ১ বছরের হতে হবে। তবে ভেড়া ও দুম্বা যদি ১ বছরের কিছু কমও হয়, কিন্তু এমন হৃষ্টপুষ্ট হয় যে দেখতে ১ বছরের মতো মনে হয়, তাহলে তা দ্বারাও কুরবানি করা জায়েজ। অবশ্য এক্ষেত্রে কমপক্ষে ৬ মাস বয়স হতে হবে। উলেখ্য, ছাগলের বয়স ১ বছরের কম হলে কোনো অবস্থাতেই তা দ্বারা কুরবানি যাবে না।
পশুর বয়সের ব্যাপারে বিক্রেতার কথা :
যদি বিক্রেতা কুরবানির পশুর বয়স পূর্ণ হয়েছে বলে স্বীকার করে আর পশুর শরীরের অবস্থা দেখেও তাই মনে হয় তাহলে বিক্রেতার কথার উপর নির্ভর করে পশু কেনা এবং তা দ্বারা কুরবানি করা যাবে।
শরীক নির্বাচনে সতর্কতা :
শরীকদের কারো পুরো বা অধিকাংশ উপার্জন যদি হারাম হয় তাহলে কারো কুরবানি সহীহ হবে না। যদি কেউ আলাহ তায়ালার হুকুম পালনের উদ্দেশ্যে কুরবানি না করে শুধু গোশত খাওয়ার নিয়ত করে কুরবানি করে তাহলে তার কুরবানি সহীহ হবে না। তাকে অংশীদার বানালে শরীকদের কারো কুরবানি হবে না। তাই অত্যন্ত সতর্কতার সাথে শরীক নির্বাচন করতে হবে।
কুরবানির ছুরি কেমন হবে :
হযরত শাদ্দাদ ইবনে আওছ রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলে কারীম (সা.) বলেন, আলাহ তায়ালা সকল কিছুর উপর অনুগ্রহকে অপরিহার্য করেছেন। অতএব যখন তোমরা জবাই করবে তো উত্তম পদ্ধতিতে জবাই কর। প্রত্যেকে তার ছুরিতে শান দিবে এবং তার পশুকে শান্তি দিবে (সহীহ মুসলিম)।
জবাইকারীকে পারিশ্রমিক দেওয়া :
আলী ইবনে আবী তালিব রা. বলেন, আলাহর নবী (সা.) আমাকে তাঁর (কুরবানির উটের) আনুষঙ্গিক কাজ সম্পন্ন করতে বলেছিলেন। তিনি কুরবানির পশুর গোশত, চামড়া ও আচ্ছাদনের কাপড় ছদকা করতে আদেশ করেন এবং এর কোনো অংশ কসাইকে দিতে নিষেধ করেন। তিনি বলেছেন, আমরা তাকে (তার পারিশ্রমিক) নিজের পক্ষ থেকে দিব (বুখারী ও মুসলিম)। অবশ্য পূর্ণ পারিশ্রমিক দেওয়ার পর পর পূর্ব চুক্তি ছাড়া হাদিয়া হিসাবে গোশত বা তরকারী দেওয়া যাবে।
জবাইয়ে একাধিক ব্যক্তি শরীক হলে :
অনেক সময় জবাইকারীর জবাই সম্পন্ন হয় না, তখন কসাই বা অন্য কেউ জবাই সম্পন্ন করে থাকে। এক্ষেত্রে অবশ্যই উভয়কেই নিজ নিজ জবাইয়ের আগে ‘বিসমিলাহি আলাহু আকবার’ পড়তে হবে। যদি কোনো একজন না পড়ে তবে ওই কুরবানি সহীহ হবে না এবং জবাইকৃত পশুও হালাল হবে না।
মৃতের পক্ষ থেকে কুরবানি :
মৃতের পক্ষ থেকে কুরবানি করা যায়। মৃত ব্যক্তি যদি ওসিয়ত না করে থাকে তবে সেটি নফল কুরবানি হিসেবে গণ্য হবে। কুরবানির স্বাভাবিক গোশতের মতো তা নিজেরাও খেতে পারবে এবং আত্মীয়-স্বজনকেও দিতে পারবে। আর যদি মৃত ব্যক্তি কুরবানির ওসিয়ত করে গিয়ে থাকে তবে এর গোশত নিজেরা খেতে পারবে না। গরীব-মিসকীনদের মাঝে সদকা করে দিতে হবে।
কুরবানির পশু কেমন হবে :
কুরবানির পশু হৃষ্টপুষ্ট হওয়া উত্তম। যে পশু তিন পায়ে চলে, এক পা মাটিতে রাখতে পারে না বা ভর করতে পারে না এমন পশুর কুরবানি জায়েয নয়। এমন দূর্বল পশু, যা জবাইয়ের স্থান পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারে না তা দ্বারা কুরবানি করা জায়েয নয়। যে পশুর একটি দাঁতও নেই বা এত বেশি দাঁত পড়ে গেছে যে, ঘাস বা খাদ্য চিবাতে পারে না এমন পশু দ্বারাও কুরবানি করা জায়েয নয়। যে পশুর শিং একেবারে গোড়া থেকে ভেঙে গেছে, যে কারণে মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সে পশুর কুরবানি জায়েয নয়। যে পশুর লেজ বা কোনো কান অর্ধেক বা তারও বেশি কাটা সে পশুর কুরবানি জায়েয নয়। যে পশুর দু’টি চোখই অন্ধ বা এক চোখ সম্পূর্ণ নষ্ট সে পশু কুরবানি করা জায়েয নয়।
কুরবানির গোশত সংরক্ষণ :
জাবির রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম (সা.) প্রথম দিকে তিন রাত পর কুরবানির গোশত খেতে নিষেধ করেছিলেন। এরপর (অবকাশ দিয়ে) বলেন, ‘খাও, পাথেয় হিসাবে সঙ্গে নাও এবং সংরক্ষণ করে রাখ’ (মুসলিম)। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. এর এক বর্ণনায় আছে যে, ‘খাও, সংরক্ষণ কর এবং ছদকা কর (মুসলিম)।
বিদেশে অবস্থানরত ব্যক্তির কুরবানি করা :
বিদেশে অবস্থানরত ব্যক্তির জন্য নিজ দেশে বা অন্য কোথাও কুরবানি করা জারয়য। কুরবানিদাতা এক স্থানে আর কুরবানির পশু ভিন্ন স্থানে থাকলে কুরবানিদাতার ঈদের নামায পড়া বা না পড়া ধর্তব্য নয়; বরং পশু যে এলাকায় আছে ওই এলাকায় ঈদের জামাত হয়ে গেলে পশু জবাই করা যাবে।
কুরবানির চামড়া বিক্রির অর্থ সাদকা করা :
কুরবানির চামড়া কুরবানিদাতা নিজেও ব্যবহার করতে পারবে। তবে কেউ যদি নিজে ব্যবহার না করে বিক্রি করে তবে বিক্রিলব্ধ মূল্য পুরোটা সদকা করা জরুরি। পরিশেষে সকল পাঠকের প্রতি অনুরোধ যে, কুরবানির সূক্ষ মাসয়ালা ও নিয়ম-কানুন জানার জন্য অবশ্যই কোন বিজ্ঞ আলেমের স্মরণাপণ্য হবেন।
(লেখক : মৎস্য-বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।)
বুধবার, ২৯ জুন, ২০২২
Author: Nilshir
Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.



0 coment rios: