মনে আছে বিষ্ণু শর্মার কথা ? যিনি অবাধ্য রাজপুত্রদের শিক্ষার জন্য অসামান্য সব গল্প সৃষ্টি করেছিলেন । তিনি আসলে মানব মনের ভেতরে লুকিয়ে থাকা গল্পভুক এক কল্পনাশক্তিকে আবিষ্কার করেছিলেন । শুধুমাত্র গল্পের মাধ্যমেই রাজপুত্ররা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছিলেন । আর তার ফলেই তারা তাদের জীবনকে বদলে সফল মানুষ হবার জন্য আগ্রহী হয়েছিলেন । এ কথা চিরন্তন সত্য যে , কিছু কিছু গল্প মানুষের জীবনে বিরাট পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে । আজ সেরকমই তিনটি জীবন বদলে দেবার মত বহু পরিচিত তিনটি গল্প ও সেগুলি থেকে যে শিক্ষা পাওয়া যায় , তা নীচে আলোচনা করা হল ।
জীবনবিজ্ঞানের এক শিক্ষক তার ছাত্রদের শেখাচ্ছিলেন, শুঁয়োপোকা প্রজাপতিতে কীভাবে রূপান্তরিত হয়। তিনি ছাত্রদের বললেন যে পরবর্তী দু’ঘন্টার মধ্যে শুঁয়োপোকা থেকে প্রজাপতি বেরিয়ে আসবে কিন্তু কেউ তাড়াহুড়ো করে প্রজাপতিকে গুটি থেকে বের করার চেষ্টা করবে না। এই বলে তিনি ক্লাস থেকে চলে গেলেন। ছাত্ররা গুটির দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। প্রজাপতি গুটি থেকে বের হওয়ার জন্য নড়েচড়ে চেষ্টা করেছিল। একটি ছাত্র দয়াপরবশে শিক্ষকের উপদেশ অমান্য করে গুটি ভেঙে প্রজাপতিকে বাইরে আসতে সাহায্য করল। ফলে প্রজাপতিকে বাইরে আসার জন্য আর বেশি চেষ্টা করতে হল না কিন্তু অল্প পরেই প্রজাপতিটি মারা গেল।
শিক্ষক ফিরে এলে অন্য ছাত্ররা ঘটনাটি তাকে জানল। তিনি ব্যাখ্যা করে বোঝালেন যে প্রজাপতিটিকে সাহায্য করতে গিয়ে ওই ছাত্রটি প্রজাপতিকে মেরে ফেলেছে। কারণ প্রাকৃতিক নিয়মে গুটি থেকে বেরনোর সময় তাকে যে সংগ্রাম করতে হয় তার ফলে প্রজাপতির ডানা দুটি বেড়ে ওঠে এবং শক্ত হয়। বালকটি প্রজাপ্রতিকে সংগ্রাম করতে না দিয়ে তাকে বাঁচবার শক্তি সংগ্রহ করতে দেয়নি। ফলে প্রজাপতিটি মারা গেল।
গল্পটি থেকে আমরা যে শিক্ষা পাই :–
১. জীবনযুদ্ধে লড়াই করার শিক্ষাই হচ্ছে জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা ।
২. নিজের জীবনী শক্তি নিজেকেই অর্জন করতে হয় ।
৩. কাউকে সাহায্য করা ভালো , কিন্তু সাহায্যের নামে তার আত্মশক্তিকে দুর্বল করা ভালো নয় । (প্রসঙ্গত বলে রাখি , অনেক বাবা মা অভিজ্ঞতার অভাবে , বেশি আদর দিয়ে সন্তানের এই আত্মশক্তিকেই দুর্বল করে ফেলেন ।)
৪. সময়ের সঠিক ব্যবহার , ধৈর্য আর প্রকৃতির উপর ভরসা রাখা প্রয়োজন ।
দ্বিতীয় গল্প:-
একজন মহিলার একটি পোষা বেঁজি ছিল। বেঁজিটি খুব বিশ্বস্ত ছিলো। একদিন মহিলাটি তার শিশুকে বেঁজিটির তত্বাবধানে রেখে বাইরে গেল। মহিলাটি বাড়ি থেকে বের হওয়ার কিছুক্ষন পর একটি কিং কোবরা সাপ বাড়িতে ঢুকলো। শিশুটি সাপ দেখে ভয়ে কাঁদতে লাগলো। বেঁজিটি সাপটির উপর ঝাপিয়ে পড়লো। অনেকক্ষন লড়াই করার পর সাপটি মারা গেল। বেঁজিটি রক্তাক্ত মুখ নিয়ে বাড়ির গেটের সামনে মহিলাটির জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো । যখন মহিলাটি বাড়িতে আসে তখন বেঁজিটিকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখতে পেল। মহিলাটি ভাবলো বেঁজিটি হয়তো তার শিশুকে কামড়েছে। তিনি হাতের সামনে একটি জলের পাত্র দিয়ে আঘাত করে বেঁজিটিকে মেরে ফেললেন । কিন্তু তিনি যখন ভিতরে প্রবেশ করলেন তখন দেখতে পেলেন, শিশুটির পাঁশে একটি মৃত কিং কোবরা সাপ পড়ে আছে। তখন তিনি নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। কিন্তু ততক্ষনে যা হবার হয়ে গেছে। মৃত বেঁজিটির জন্য চোখের জল ফেলা ছাড়া তার কিছুই করার ছিল না।
এই গল্পটির থেকে কী শিক্ষা পাই:-
১. আমরা অনেক সময় দ্রূত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি এবং ধারণার উপর কাজ করি, এটা করা ঠিক নয় ।
২. চোখে দেখা মাত্রই বা কারো মুখে শোনা মাত্রই কোনো বিরাট সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয় ।
৩. কাউকে চট করে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস করতে নেই ।
তৃতীয় গল্প:
একজন বয়স্ক রাজমিস্ত্রী তার কাজ থেকে অবসর নিতে চাইলো। তাই সে তার মালিকের কাছে গিয়ে বললো, ‘বস, আমি এই বাড়ি বানানোর কাজ থেকে অবসর নিয়ে আমার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের সাথে সময় কাটাতে চাই।’
তার মালিক এতে কিছুটা দুঃখ পেল কারণ সে ছিলো সবচেয়ে দক্ষ ও কর্মঠ রাজমিস্ত্রী। সে বললো,‘ঠিক আছে, কিন্তু তুমি কি চলে যাওয়ার আগে আর একটি মাত্র বাড়ি বানাতে আমাদের সাহায্য করবে?’ বয়স্ক রাজমিস্ত্রী এই প্রস্তাবে সানন্দে রাজী হয়ে গেল। কিন্তু কাজ শুরু করার পর দেখা গেল তার মন সেখানে ছিল না এবং সে সবসময় তার অবসরের কথা ভেবে অন্যমনস্ক থাকতো। সবসময় সে বাড়ির চিন্তা করতো। তাই এর আগে যত কাজ সে করেছিলো এই কাজটাই তার করা সবচেয়ে খারাপ কাজ হয়ে গেল।
যখন সে বাড়িটি তৈরী করা শেষ করলো তখন তার মালিক বাড়িটি দেখতে এলো এবং বৃদ্ধের হাতে বাড়ির চাবি দিয়ে বললো, ‘এটা এখন থেকে তোমার বাড়ি, তোমার প্রতি আমার উপহার।’
এই কথা শুনে বৃ্দ্ধ আফসোস করে উঠলো!
সে মনে মনে ভাবলো, ‘হায় হায়! যদি আমি শুধু একবার জানতাম যে আমি আমার নিজের বাড়ি তৈরী করছি! তাহলে এটা আমার জীবনে করা সবচেয়ে ভাল কাজ হতো!’
বাস্তবেও আমরা প্রতিটা দিন আমাদের জীবনকে এই বাড়ির মতই তৈরী করে চলেছি। কিন্তু আমরা প্রায়ই তা ভুলে যাই। আর তাই সব কাজে আমাদের ভালটার চেয়ে অনেক কম চেষ্টাটা করি, অনেক কম পরিশ্রমটা দেই। আমরা যদি আজ এই সত্যটা উপলব্ধি করতে পারি তবে আমরা হয়তো আমাদের সেরা পরিশ্রমটাই দিতে পারবো। আমরা আমাদের জীবনের ফেলে আসা দিনে ফিরে যেতে পারি না, আপনার জীবনের সেই রাজমিস্ত্রীটি আপনিই, যে প্রতিদিন ইট, কাঠ, পেরেক দিয়ে আপনার জীবনটাকে গড়ে তুলছেন। আপনার আজকের কাজ, চেষ্টা, পরিশ্রম আগামী দিনের সেই বাড়িটা তৈরী করবেন যেখানে আপনি থাকবেন। তাই আজই যত্নবান হোন!
গল্পটি থেকে আমরা কী শিখতে পারি :-
১. ফাঁকি দিলে নিজেকেই ঠকানো হয় ।
২. কোনো কাজকেই ছোটো করে দেখা উচিত নয় ।
৩. সমস্ত কাজে ধৈর্য্য রাখা উচিত ।
৪. প্রতিটি কাজে নিজের সেরাটুকু দেওয়ার চেষ্টা করা উচিত ।
৫. মৃত্যু ছাড়া জীবনের কোনো অবসর নেই । তাই সক্ষম থাকা পর্যন্ত কাজ করে যাওয়া উচিত ।
বুধবার, ২৯ জুন, ২০২২
Author: Nilshir
Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.



0 coment rios: