বুধবার, ২৯ জুন, ২০২২

গ্রাম বাংলার হারিয়ে যাওয়া খেলা ও আমাদের আধুনিকতা।

নীল-সাদা স্ক্রিনের রঙ্গিন দুনিয়ার মোহ মানুষকে দিন দিন করে তুলেছে অন্তর্মুখী। বন্ধুদের সাথে আড্ডা কিংবা খেলাধুলার সময়ের জায়গায় এখন হাতে উঠে আসে স্বপ্রতিভ মুঠোফোন কিংবা ল্যাপটপ। কী শিশু-কিশোর, কী তরুণ, কী বয়স্ক সবাই যার যার পছন্দের জায়গায় ঢুঁ মারছে হাতে থাকা যন্ত্রের মধ্যে। মাঠের বিনোদন এখন ছোট যন্ত্রে বন্দি।
বর্তমান প্রজন্ম মাঠের অনেক বিনোদনের সাথেই অপরিচিত। বাংলার আনাচেকানাচে একসময় হরেক রকমের খেলা প্রচলিত থাকলেও এখন সেগুলো অনেকটাই বিলুপ্তপ্রায়। কানামাছি, গোল্লাছুট, ডাংগুলি, মার্বেল খেলা, মোরগ লড়াই, ষোল গুটি খেলার নাম এবং স্থানীয় নিয়ম এই প্রজন্মের কাছে একেবারেই অচেনা। যত্ন করে নিজের হাতে বানানো ঘুড়ি আকাশে ওড়ানোর মজা এখন শুধুই কল্পনা। ঘুড়ি উড়বে কিন্ত শব্দ হবে না তা কী করে হয়? ঘুড়ির মাথায় বাঁশ আর তালপাতা দিয়ে বানানো বিশেষ জিনিসটার (ভোঁরা, ভ্রমরের মত ভোঁ ভোঁ আওয়াজ করে বিধায় আঞ্চলিক ভাষায় ডাকা নাম) শব্দ কানে মধুর ঝংকার হয়ে বাজতো। বাজার থেকে কেনা লাটিমের সাথে নিজের হাতে বানানো লাটিম যখন ভোঁ ভোঁ শব্দে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জানান দেয় তার সুখ শুধু যারা ঘুরিয়েছে তারাই জানে। শুধু কি লাটিম ঘুরানো? একটা লাটিম কত ভাবে যে ঘুরানো যায় তার প্রদর্শনী দেখাটাও চোখের প্রশান্তি এনে দিতো।
গ্রামের বড় রাস্তা কিন্তা মসৃণ ঘাসের মাঠে যুবকদের বুদ্ধি এবং শক্তির খেলা কাবাডি তো এখন স্বল্প পরিসরে ইনডোরে স্থান নিয়েছে। বাংলাদেশের জাতীয় খেলা হওয়া সত্ত্বেও এর প্রসার এখন খুব সীমিত। বিভিন্ন বাহিনী বা প্রাতিষ্ঠানিক ক্রীড়া দল ছাড়া খুব একটা চর্চা করা হচ্ছেনা এই খেলার। বিকেলের নরম আলোয় মাটির তৈরি তৈজসপত্রের ভাঙ্গা টুকরো দিয়ে কিশোর- কিশোরীরা, এমনকি তরুণীরাও মাটিতে দাগ কেটে কুতকুত খেলতো যা এখন বলতে গেলে দেখাই যায় না। একসময় বাড়িতে কোন অনুষ্ঠান হলেই ভাই-বোন এবং আগত সমবয়সী বা সমমনাদের নিয়ে বিভিন্ন ঘরোয়া খেলার যে আয়োজন হত তার তুলনা অন্য কিছুর সাথে বড্ড বেমানান। রাম-শ্যাম-যদু-মধু, লুডু, সাদা কাগজে ক্রিকেট খেলা সহ অসংখ্য খেলা এখন শুধুই মধ্য বয়সীদের কাছে স্মৃতি আর তরুণ, কিশোরদের কাছে অজানা দুনিয়া।
যে দুনিয়ায় অবাধ বিচরণে পারিবারিক বন্ধনটা দৃঢ় হয় সে দুনিয়া থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্তর্জালের রঙিন দুনিয়ায় একান্ত একাকী সময় কাটানোই এখনকার প্রজন্মের মূল ভাবনা। হারিয়ে যাওয়া সেসব সোনালি দিন আর কখনো ফিরে আসবে না। একসময় বিভিন্ন খেলার নামগুলোও হারিয়ে যাবে চুড়ান্তভাবে। আমরাও আরো ডুবে যাবো নিজেদের মধ্যে। ভুলে যাবো হাসতে, আড্ডা দিতে। কেউ মজার কোন জোকস বললেও আমরা কোন রকমে নিজের দুনিয়া থেকে সরে এসে একটা মুচকি হাসি দিয়ে আবার ডুব দেবো নীল-সাদা স্ক্রীনের রঙ্গিন আলোয়।

শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.

0 coment rios: